মেধাবীদের আমরা রাখব কী দিয়ে?

মেধাবীদের আমরা রাখব কী দিয়ে?

পড়তে সময় লাগবে: 5 মিনিট...

পৃথিবীতে একটি দেশও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে দেশটি মেধাকে অবহেলা করে এগিয়ে গেছে। ১৬ কোটি মানুষের বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশ। কেউ দেশে থেকে কাজ করবে, কেউ বিদেশ গিয়ে কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক ! প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছে। পড়াশোনা শেষে নিজের মেধা কাজে লাগিয়ে সেখানেই ভালো কাজ করছে, এটা অবশ্যই সুখবর। কিন্তু আমাদের বেশির ভাগ মেধাবীই যদি এই মাটির কাছে ঋণী না হয়ে অন্য দেশে থেকে যায় তবে তা আমাদের জন্য খুবই দুঃশ্চিন্তার বিষয়। কেবলই দুঃশ্চিন্তা নয় এটা জাতি হিসেবে আমাদের কাছে চরম লজ্জা ও কলঙ্কের। একজন কৃতি শিক্ষার্থীর শিক্ষা সমাপনীতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়।

মেধা পাচার কিঃ মেধা পাচার বলতে সাধারণত বুঝায় কোন দেশের মেধাবী শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং দক্ষ জনশক্তির নিজ দেশ ত্যাগ করে বিদেশকে কর্মক্ষেত্র হিসেবে স্থায়ীভাবে বেছে নেয়া। এই মেধা পাচার ঘটে সাধারণত অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ থেকে। কম বেশি সকল দেশেই এই সমস্যা আজ প্রকট।

মেধা পাচার কেন হচ্ছেঃ চলুন ভিন্ন ভিন্ন তিনটা গল্প শুনি। গল্প তিনটা ভিন্ন আঙ্গিকে হলেও এর আবেদন একই।

গল্প ১: রূপক বুয়েটের মেকানিক্যালের এক মেধাবী ছাত্রের নাম। প্রথম বর্ষ থেকেই সে কিছু একটা করতে উদগ্রীব। তাঁর সামান্য টিউশনির টাকায় সে জিঞ্জিরা থেকে লোহা কিনে, ধোলাইখাল থেকে মটর কিনে একটা রোবট বানাতে চেষ্টা করে। কিন্তু মানের অভাবে , টাকার অভাবে রূপক যেভাবে চাচ্ছিল রোবট টা ঠিক সে রকম ছিল না। রুপকের পক্ষেও ভালো কাঁচামাল কিনা সম্ভব হচ্ছিল না , বিদেশ থেকে ইমপোর্ট করা তো অনেক দূরের ব্যাপার । রূপক তাঁর স্বপ্নকে আলোর মুখ দেখাতে একজন স্পন্সর খুঁজছিল। এ দুয়ার থেকে সে দুয়ার ঘুরে সে কোনভাবেই সফল হয়নি। অবশেষে রুপকের গল্পের শেষটা খুবই গতানুগতিক হয়। বিদেশে পাড়ি জমানো। রুপকের রিসার্চ প্রপোসাল দেখে বিদেশি এক কোম্পানি তাঁকে লুফে নেয়। রূপক সহজেই ভিসা পেয়ে উড়াল দেয় সাদা চামড়াদের দেশে। দেশের মেধাবী সন্তানটা বিদেশে পাচার হয়ে যায়।এ রকম শত রূপক প্রতি বছর আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের সূর্য সন্তানদের।

গল্প ২: মিম্ময় BSMMU হেমাটোলজি বিভাগের এক মেধাবী চিকিৎসক। মিম্ময় হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করতে চায়। সেটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ । তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল সে গবেষণা টা করবে কোথায়। বাংলাদেশে তো গবেষণার তেমন কোন ক্ষেত্র নেই বললেই চলে। যাও আছে সেখানে অনভিজ্ঞদের সুযোগ দেয়া হয় না। কিন্তু সুযোগ না দেয়া হলে অভিজ্ঞতা টা আসবে কই থেকে? তাঁর মেধা কি তবে অংকুরেই বিনষ্ট হবে? বাংলাদেশের গবেষণা ক্ষেত্র যদি কেবলই বিশ্ববিদ্যলয়ের মহান সম্মানিত শিক্ষকদের এবং বিদেশীদের জন্যই বরাদ্দ থাকে তবে অত্যন্ত মেধাবী মিম্ময়রা কোথায় যাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর যেমন মিম্ময়ের জানা নেই, তেমনি ভাবে জানা নেই আমাদের কারো। উত্তর না পেয়ে অভিমানী মিম্ময় চলে যায় যে দেশে গবেষণার অনেক সুযোগ আছে, যে দেশ তরুণদেরও গবেষণার কাজ করার সুযোগ দেয়। কি দিয়ে আমরা মিম্ময়দের অভিমান ভেঙ্গে এ দেশে রেখে দিব, আবার জাতির চরম এই মেধাবী সন্তানদের আমরা রেখেই বা কি করব।

গল্প ৩: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজীর এক মেধাবী শিক্ষার্থী রুবেল। বিখ্যাত কয়েকটা জার্নালে তাঁর পাব্লিকেশন আছে। সে Micro Organism নিয়ে একটু রিসার্চ করতে চায়। রুবেল বিশ্বাস করে তার এই আবিষ্কার বহু মানুষের জীবন বাঁচাতে পারবে। সে গবেষণার নিরিখে একটা গবেষণা ফার্ম এ কাজ করার জন্য ইচ্ছা পোষণ করে। খুবই হাস্যকর একটা সম্মানি মাসিক ভিত্তিতে তাঁকে অফার করা হয় যা দিয়ে ২০১৯ সালে জীবন ধারণ প্রায় অসম্ভব। সবচেয়ে দুঃখ জনক ব্যাপার হল এই ধরণের সম্মানি রুবেলদের মত মেধাবীরা কেন যে কোন ধরণের পেশাজীবীদের জন্যই অনেক কম। অবশেষে অভিমানী রুবেলও রূপক, মিম্ময়দের মত মেধাকে কদর করা দেশে পাড়ি জমায়।

এভাবেই বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থী হারাচ্ছে। সহজ কথায় বলতে গেলে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অনেক মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে।বাংলাদেশে মেধার মূল্যায়ন নেই, তাই উন্নত দেশে পাড়ি দিতে হবে’—এই সনাতনী ধারণাটির বশে অনেক তরুণকে বুঁদ হয়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁদের মতে বাংলাদেশে গবেষণার কোন সুযোগ নেই। তবে তাঁদের এই দাবিকে কিন্তু একেবারে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে গবেষণার ক্ষেত্র আসলেই নেই বা খুবই সীমিত। আমরা আমাদের মেধাবীদের মূল্যায়ন করতে পারিনা। তাদেরকে যথাযথ সম্মান, পারিশ্রমিক দিতে পারিনা। বাংলাদেশে বেকার সমস্যা প্রকট।

মেধা পাচার এক অভিশাপঃ

খুবই প্রচলিত একটা সত্য কথা হল গ্লাস কখনও খালি থাকেনা। হয় বায়ু দিয়ে, না হয় পানি দিয়ে। আমাদের দেশের মেধাবীরা যখন এই দেশ থেকে চলে যাবে , দেশের নেতৃত্ব চলে যাবে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের কাছে। একজন কৃতি শিক্ষার্থীর শিক্ষা সমাপনীতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। যেমন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় হচ্ছে ৫ লাখ টাকার অধিক, একজন বুয়েটের শিক্ষার্থীর শিক্ষা সমাপনীতে ব্যয় হচ্ছে ১০ লাখ টাকা, আর একজন সরকারি মেডিকেলের শিক্ষার্থীর পেছনে ১৫ লাখ টাকার উপর । বাংলাদেশের এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে জনগণের করের টাকায়। অথচ মেধা পাচারের সুফল ভোগ করছে উন্নত বিশ্ব। এছাড়া দেশের বড়বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোর নেতৃত্ব প্রদানে বিদেশী নাগরিকদের নিয়োগ দিয়ে থাকে৷ দেশের কোটি কোটি টাকা চলে যাচ্ছে বিদেশে। তার মানে দাঁড়াল আমরা একই সাথে টাকাও হারাচ্ছি, মেধাও হারাচ্ছি। আমারা যেন এক লুপের মধ্যে আটকে গেছি। এই লুপ থেকে আমরা বের হব কি দিয়ে।

মেধা পাচার বন্ধের উপায়ঃ

  • সবার প্রথম যেই জিনিসটা জরুরি তা হল তরুণদের মাঝে মূল্যবোধ তৈরি করা, দেশপ্রেম তৈরি করা। একজন সফল মানুষ হওয়ার চেয়ে একজন দেশপ্রেমিক হওয়া বেশি জরুরি- এই কথার বীজ ছাত্র অবস্থাতেই তাঁদের মাঝে বপন করতে হবে।
  • মেধাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। মেধার যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। মেধা পাচার রোধে সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেধাবীদের ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিবছর বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের বেতন দেওয়া হয় প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ আমাদের দেশের মেধার মূল্যায়ন করা হয় সামান্য বেতন দিয়ে।
  • উদ্যোক্তা তৈরির মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে। যাতে তারা নিজেরা আত্মকর্মসংস্থান করে অন্যদেরও কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
Man pulls the rope with brain drain

আলোকবর্তিকা নিয়ে হাজির হয়েছে পাই লাবসঃ

তবে আশার কথা হচ্ছে গত এক যুগেরও উপরে পাই ল্যাবস বাংলাদেশের গবেষণা ক্ষেত্রে এক বিপ্লব সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। পাই ল্যাবস বাংলাদেশ মূলত একটা গবেষণা মূলক প্রতিষ্ঠান যা ছোটদের বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী করছে, নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করে দেশের টাকা দেশেই রাখতে সাহায্য করছে, মেধাবীদের কাজের সুযোগ দিয়ে মেধা পাচার কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এই পর্যন্ত আমাদের সফলতার গল্প আছে অনেক। ছোট বাচ্চাদের খেলনা তৈরি করা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সুষ্ঠ নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক EVM (Electronic Voting Machine) আবিষ্কার করে আমরা আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের কিছুটা প্রয়াস পাই। পাই ল্যাবস এর মত যারা বাংলাদেশের গবেষণা নিয়ে কাজ করে তাঁরা আপনাদের সুপরামর্শের দিকে তাকিয়ে থাকে। আপনাদের পাশে থাকা, সাথে থাকা আমাদের জন্য অনেক কিছুই যায় আসে।

পরিশেষেঃ

মোদ্দা কথা হল , মেধা পাচার যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে। নতুবা ইউরোপ , আমেরিকা আমাদের দেশের মেধাকে নিজেদের কাজে লাগিয়ে আরও এগিয়ে যাবে। আর আমরা তৃতীয় বিশ্বের এক সুবিধাবঞ্চিত দেশ হয়ে কেবলই হা হুতাশ করব।

 59 total views,  1 views today

Share your vote!


Related Posts

To Buy Prohori

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

© 2024