গত এক দশক থেকে সবচেয়ে বেশী উদ্ভাবন ঘটেছে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির জগতে। প্রযুক্তির দুনিয়ায় প্রতি বছরই যোগ হচ্ছে অভাবনীয় সব আবিষ্কার। প্রায় সমাপ্ত ২০১৭ সালকেও স্মরণ করা হবে অনেকগুলো প্রযুক্তির আবিষ্কারের বছর হিসেবে। এ বছরের অসংখ্য নতুন প্রযুক্তি ও গবেষণা থেকে আলোচিত ১০টি আবিষ্কার সংক্ষেপে জানবো।
১. পক্ষাঘাত নির্মূলে
আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে নির্দেশ দেয় মস্তিষ্কের আলাদা আলাদা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ(স্নায়ু)। তাই আমাদের মস্তিষ্ক চাইলে আমরা হাটি, দৌড়াই, কুস্তী করি। কিন্তু, দুর্ঘটনায় মস্তিষ্কের কোন অংশ নিয়ন্ত্রণহীন(প্যারালাইসড) হয়ে পড়লে ঐ অংশ নিয়ন্ত্রিত অঙ্গটিতে মস্তিষ্ক আর নির্দেশ পাঠাতে পারে না; ফলে অঙ্গটি হয়ে পড়ে অসাড়।
কিন্তু যদি মস্তিষ্কে ছোট্ট একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র বসানো যায়, যেটি মস্তিষ্কের সংবেদনহীন অংশের হয়ে নির্দেশনা গ্রহণ করবে এবং প্রেরণ করবে সেই হাত কিংবা পায়ে। তখন ? মস্তিষ্ক হাঁটা কিংবা দৌড়ানোর সেই সংকেতটি পেয়ে হাঁটবে, কুস্তী করবে। বিজ্ঞানীরা এ বছর পরীক্ষাটি করেছিলেন একটি প্যারালাইসড বাঁদরের উপর। বিজ্ঞানীর ভাষায় “বাঁদরটি হাঁটার কথা ভাবছিল, তারপর একটি ছোট্ট স্ফূরণ ঘটলো ওর মস্তিষ্কে এবং এটি চলতে শুরু করলো!”
কিন্তু সমস্যা হলো বিজ্ঞানীরা যন্ত্রটিকে এখনো যথেষ্ট ছোট এবং তারহীন করে তুলতে পারেন নি। তাই এর পরবর্তী ধাপ হলো এটিকে তারহীন ছোট্ট ডিভাইস করে তোলা যাতে সেটি মস্তিষ্কের ফোঁকরে বসিয়ে দেয়া যায় সহজেই! ল্যাব থেকে মস্তিষ্কে বসাতে বসাতে চিকিৎসকদের অপেক্ষা করতে হবে ১০-১৫ বছর!
২. চালকবিহীন ট্রাক
চালকবিহীন গাড়ি পুরনো প্রযুক্তি। তবে এই বহরে এ বছর যুক্ত হচ্ছে চালকবিহীন ট্রাকও! লেজার, রাডার আর ক্যামেরা ব্যবহার করে এই ট্রাক রাস্তায় মানুষ ও যানবাহনের অবস্থান বুঝতে পারবে এবং নিজেই ট্রাকের গতি, ব্রেক নিয়ন্ত্রণ করবে সময় অনুযায়ী। সিঙ্গাপুরে এর পরীক্ষামূলক ব্যবহারও শুরু হয়েছে। ২০২০ সাল নাগাদ এটিকে নিয়মিতভাবে দেখা যাবে উন্নত দেশগুলোর সড়কে।
সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর বড় অংশ ট্রাকের মাধ্যমে ঘটে। আশা করা হচ্ছে দুর্ঘটনা কমাতে এই চালকবিহীন ট্রাক ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
৩. কোয়ান্টাম কম্পিউটার
বহু বছর ধরে চলে আসা উচ্চতর গবেষণার মধ্যে একটি হলো কোয়ান্টাম কম্পিউটার। সায়েন্স ফিকশনে পড়া গল্পের মতই এটি শক্তিশালী কম্পিউটার যা নির্দেশবিহীনভাবে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়, করতে পারে জটিল কোন গবেষণা। কোয়ান্টাম কম্পিউটার মুলত পদার্থবিদ্যার কোয়ান্টাম তত্ত্বকে ভিত্তি করে তৈরী কম্পিউটার যেখানে কেবল ০,১ বিট ব্যবহার না করে স্বতন্ত্র কোয়ান্টাম বিটসের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে বলা যায় মানব মস্তিষ্কের প্রতিরূপ। কবে নাগাদ কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরী করা সম্ভব হবে এ নিয়ে চলছিল জল্পনা-কল্পনা। এ বছর এক দল বিজ্ঞানী কোয়ান্টাম কম্পিউটার এর মূল কাঠামোকে উদ্ভাবন করতে পেরেছেন। তাই আশা করা যাচ্ছে ৫ বছরের মধ্যেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার চলে আসবে পৃথিবীকে তাক লাগাতে।
৪. ক্রেডিট কার্ডের বিকল্প? কেবল মুখ দেখালেই!
মোবাইলের লক খুলতে আমরা প্রায়শই ফেস লক অ্যাপ ব্যবহার করি যা আমাদের অতি পরিচিত একটি প্রযুক্তি। তবে এবছর তাতে এতটাই নিখুঁত প্রযুক্তি যোগ করা হয়েছে যে আর্থিক লেনদেনের মত সংবেদনশীল কাজেও ফেস রিকগনিশনের উপর ভর করছে চীনের প্রায় ১২ কোটি মানুষ। এক্ষেত্রে ব্যাংক প্রথমে সকল একাউন্টধারীদের ডাটাবেইস তৈরী করে নিখুঁত ছবিসহ। তালিকায় থাকা মানুষটি টাকা জমা কিংবা উত্তোলনের জন্য ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে যন্ত্রটি প্রতিটি মুখ থেকে ৮৩টি ভিন্ন ভিন্ন বিন্দু এবং তাদের দুরত্ব ক্যালকুলেট করে তাদের শনাক্ত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একাউন্টে টাকা জমা কিংবা তুলে দেয়। এমনকি কাঁচের ঐ পাশে টাকা নিতে আসা মানুষটি জীবিত কি না তা মুখ নাড়িয়ে এবং কথা বলে তার পরীক্ষাও নেয় যন্ত্রটি!
চীনে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে বিপণী বিতান, কফি শপ গুলোতে ক্রেডিট কার্ডের বিকল্প হিসেবে। এই প্রযুক্তির মূল উদ্দেশ্য কার্ডবিহীন সহজ সুবিধা দেয়া যেখানে গ্রাহককে লেনদেনের জন্য সাথে আনতে হবে কিছুই।
৫. জন্মগত সমস্যা রুখতে জিন থেরাপি
গত শতক থেকে মেডিক্যাল সায়েন্সের ব্যপক উন্নয়নের ফলে অকালমৃত্যু হার কমেছে, বেড়েছে আয়ু। কিন্তু প্রতিনয়ত বাড়ছে অনিরাময়যোগ্য কঠিন অসুখ আর তার বংশানুক্রমিক ধারাবাহিকতা। বংশানুক্রমিক রোগসমূহকে দূরে করতে এ বছর কাজ শুরু হয়েছে জিন থেরাপি নিয়ে।
অনিরাময়যোগ্য রোগগুলোর প্রতিকার না করা গেলেও, ত্রুটিপূর্ণ জিনকে ল্যাবে আগে থেকে প্রস্তুত সবল জিন দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা গেলে কমে যাবে জন্মগত ত্রুটি, হৃদরোগ, ক্যান্সারের মত জটিল অসুখগুলোকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মনে করছেন জিনবাহিত রোগগুলোকে নির্মূল করতে জিন থেরাপি সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
৬. নিরাপদ প্রযুক্তি
আইওটি(ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাসার ইলেকট্রনিকসকে হোম গ্যাজেট করে তোলা যা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। যেমন ফ্রিজে বাজার নেই? ফ্রিজ নিজেই কি লাগবে জানিয়ে দিবে আপনার স্মার্টফোনে) বর্তমান সময়ের সাড়া জাগানো প্রযুক্তি। তবে এর বড় সমস্যা সবসময় নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকায়, হ্যাকারদের হামলা হয় এবং কম্পিউটারটি হ্যাকারদের নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়ে যায়(বটনেট)। এই আক্রমণ ঠেকাতে এ বছরের প্রযুক্তি সমাধান হলো আইওটি আগে থেকে ডাউনলোড করে রাখা তথ্য অনুযায়ী অফলাইনে কাজ করবে। ফলে গ্রাহক নির্বিঘ্নে আইওটি ব্যবহার করতে পারবে।
৭. উষ্ণ সোলার সেল
সৌরবিদ্যুত নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির মধ্যে অন্যতম। তবে এটি ব্যবহারের দিক থেকে পিছিয়ে আছে এর এনার্জি ইফিসিয়েন্সির কারণে। এমআইটির একদল বিজ্ঞানী সোলার প্যানেলের সীমাবদ্ধতা কাটাতে তৈরী করেছে করেছে ‘উষ্ণ সোলার সেল’; যা আগের প্যানেলের চাইতে আকারে ছোট, কার্যক্ষমতা ৩০ শতাংশ বেশী; এমনকি প্রতিকূল আবহাওয়াও এর বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনও অক্ষুণ্ণ থাকে। সূর্য থেকে পাওয়া এই বিপুল তাপশক্তিকে এই সোলার সেল কাজে লাগাতে পারলে পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ হবে অনেকটাই।
৮. ৩৬০ ডিগ্রী সেলফি
সেলফি তুলতে নিয়ে জানে না এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে। তবে এতে আরো সুবিধা যোগ করেছে ৩৬০ ডিগ্রী প্রযুক্তি। একটি ছবি সাধারণত লেন্সের সামনের দৃশ্যকে ক্যাপচার করে। কিন্তু ক্যামেরা ধরে রাখার বিপরীত দিকের ছবিও পাওয়া যাবে ৩৬০ ডিগ্রী প্রযুক্তিতে। এ বছর হার্ভার্ডের একদল বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছে ৩৬০ ডিগ্রী সেলফি প্রযুক্তি যেটি শুধু সামনে ধরে রাখলেই উপর-নীচ, সামনে-পেছনে চারপাশকেই তুলে আনে। এ বছর দ্রুততম সময়ে জনপ্রিয়তা পাওয়া প্রযুক্তি ৩৬০ ডিগ্রী ক্যামেরা।
৯. মানুষ কিসের তৈরী?
মানুষ কিসের তৈরী? এ বিষয়ে ধর্মগ্রন্থগুলোতে নানা মত আছে। মানব শরীর আদতে কি পদার্থে তৈরী তা বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের দিক থেকে দেখতে এ বছর একটি গবেষণা শুরু করা হয়েছে যেখানে মার্ক জাকারবার্গ ও প্রিসিলা চ্যান দম্পতি ৩ বিলিয়ন ডলার অনুদান করবেন।মূলত, নিউরন, হার্ট, ফুসফুস, কিডনী এরকম প্রত্যঙ্গগুলোর ভিন্ন ভিন্ন কোষ কি থেকে তৈরী তা গবেষণা করবে এই প্রকল্প। এটি অনেকটা ম্যাপের মত যেখানে শরীরের শত রকমের কোষকে বিস্তৃত পরিসরে দেখাবে।
১০. রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং
রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিংকে বলা যায় মেশিন বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নিজের আবিষ্কার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ফেসবুক বা ইউটিউব আমাদের সেই নিউজ বা এড গুলোই দেখায় যা আমরা দেখতে চাই। এক্ষত্রে আসলে, ফেসবুক বা ইউটিউব আমাদের কন্টেন্ট দেখার এলগরিদম এনালাইসিস করে নিজে নিজে বুঝে নেয় কাকে কী দেখাতে হবে ; যা প্রোগ্রাম করে শেখানো যেতো না। এটিই মেশিনের রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং।
এই রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং ব্যবহার করা হবে চালকবিহীন গাড়িগুলোকে রাস্তায় চালাতে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও রেসিং কার চালাতে মেশিন লার্নিং এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ গবেষণার অবদানে প্রতি বছরই আবিষ্কৃত হয় নতুন নতুন সব প্রযুক্তি। বিজ্ঞানের নতুন নতুন উদ্ভাবন প্রতিদিনের জীবনকে করে তুলেছে সহজ আর নির্ঝঞ্ঝাট। জীবনকে নিরাপদ করতে সবুজ পৃথিবীর এইসব প্রযুক্তি হয়ে উঠুক আরো মানবিক। আর সেই মানবিকতায় উদ্ভাসিত হোক আপনার আগামী।
তথ্যসূত্রঃ MIT Technology Review.
59 total views, 1 views today