একবিংশ শতাব্দী গড়ে দিবে যে চারটি প্রযুক্তি

একবিংশ শতাব্দী গড়ে দিবে যে চারটি প্রযুক্তি

পড়তে সময় লাগবে: 4 মিনিট...

কেমন হবে আগামী দিনের পৃথিবী? প্রশ্নটার উত্তর দিতে হলে আমাদের যাচাই করতে হবে বর্তমান প্রযুক্তির অগ্রগতি। কোন কোন প্রযুক্তি আলোচনায় আসছে বেশি এবং এরা মানুষের জীবনে কি ধরণের প্রভাব ফেলছে।সেই সাথে জানতে হবে গবেষণা বেশি হচ্ছে কোন প্রযুক্তিগুলো নিয়ে। নিচে যে চারটি প্রযুক্তির উল্লেখ কথা উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে প্রযুক্তিগুলো পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে, অথবা জন্ম দিয়েছে নতুন বিতর্কের । প্রযুক্তিগুলো কি এবং কেন এরা গুরুত্বপূর্ণ, তাই নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে লেখাটিতে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

এই শতাব্দীতে এর মধ্যে অভূতপূর্ব প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। প্রযুক্তিটি মূলত কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি শাখা। উদ্দেশ্য, মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা করার যে পদ্ধতি তা কম্পিউটার দিয়ে অনুকরণ করার চেষ্টা করা। ফলে কম্পিউটার নিজে থেকে একটি কাজ শিখতে পারবে এবং এভাবে নিজের কর্মদক্ষতা নিজেই বাড়াতে পারবে। চেহারা-কণ্ঠ-হাতের লেখা শনাক্তকরণ থেকে শুরু করে স্বনিয়ন্ত্রিত গাড়ি, সব জায়গায় ব্যবহার বাড়ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। গুগল ,ফেইসবুক ,মাইক্রোসফটসহ সকল শীর্ষ তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানিগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর হয়ে পড়ছে। আবার নতুনভাবে বাড়ছে শিল্পক্ষেত্রে অটোমেশন। খুব শীঘ্রই এমন ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে, যেখানে যন্ত্র মানুষকে প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। কাজেই এ শতাব্দীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় দারুণ পরিবর্তন আনবে।

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সিস্টেমের ব্যবহার খুব শীঘ্রি শুরু হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিটির ব্যবহার নিয়ে অনেকে শঙ্কিত । বারুদ, আর পারমাণবিক অস্ত্রের পরে যুদ্ধের জন্য স্বনিয়ন্ত্রিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারকে বিশেষজ্ঞরা যুদ্ধক্ষেত্রের তৃতীয় বিপ্লব বলে আখ্যা দিয়েছেন। কৃত্ৰিম বুদ্ধিমত্তা বিশিষ্ট সিস্টেম গবেষণায় মানুষকে আরো সতর্ক হবার আহ্বান জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানি স্টিফেন হকিং।তিনি বলেছিলেন- ,“কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরিতে সফল হলে ,তা হতে পারে মানব সভ্যতার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। দুর্ভাগ্যবশত, এটা হতে পারে সর্বশেষ আবিষ্কার যদি না আমরা এর ঝুঁকি প্রশমন করি।”

পুনঃ ব্যবহার যোগ্য রকেট প্রযুক্তি

২০১৫ সালে প্রথমবারের মত রকেট অবতরণে সফল হয় স্পেস-এক্স। রকেটের মডেলটি ছিল ফ্যালকন ৯। প্রায় ১০০ কিলোমিটার উচ্চতা এবং কক্ষপথীয় বেগ থেকে ফিরে এসে ভূমিতে অবতরণ করেছিল রকেটটি। রকেট প্রযুক্তির অগ্রগতিতে ঘটনাটি ছিল এক বিশাল মাইল ফলক।

রকেট উৎক্ষেপন একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল ব্যাপার। কারণ এতদিন একটি রকেট একবার উৎক্ষেপন করা হলে ,রকেট বুস্টারটি আর ফিরিয়ে আনা হতো না। সমুদ্রে পতিত হতো বুস্টার । ঘটনাটি একটা বিমান কেবল একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়ার মতো। একটা বিমান বারবার ব্যবহার করা না হলে ,নিশ্চয়ই একটি টিকিটের দাম হতো কয়েক কোটি টাকা! ঠিক একই ঘটনা এবার ঘটছে রকেট শিল্পে। পুনর্ব্যবহারের ফলে এরই মধ্যে উৎক্ষেপণ ব্যয় প্রায় তিনগুন কমাতে পেরেছে স্পেস-এক্স।ভবিষ্যতে ব্যয় আরো কমবে। ফলাফল হল এক নতুন ‘রকেট বিপ্লব’।

আবার রকেট উৎক্ষেপণের ইতিহাসে এ শতাব্দীতে প্রথমবারের মতো ব্যক্তিমালিকানাধীন কিছু প্রতিষ্ঠান আবির্ভাব হয়েছে। ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের সাথে আছে জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন্স আর রকেট ল্যাব নামের ভিন্ন আরেকটি কোম্পানি। প্রতিযোগিতা করছে বোয়িং, লকহিড মার্টিনের মতো অভিজ্ঞ ও পুরানো কোম্পানির সাথে। বিশেষজ্ঞরা এই প্রতিযোগিতাকে বলছেন দ্বিতীয় স্পেস-রেস।

মানুষের ভবিষ্যৎ মহাকাশে। আর মহাকাশে যেতে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ধাপ হল রকেট উৎক্ষেপণ। রকেট উৎক্ষেপণ ব্যয় যত কমবে, ততো সহজে যাওয়া যাবে মহাশূন্যে।এর উপর ভিত্তি করেই এই শতাব্দীতে পরিকল্পনা করা হচ্ছে মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের। ২০২২ সাল থেকে মিশন শুরু করে ,২০৫০ সালের মধ্যেই মঙ্গলে স্বনির্ভর কলোনি স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে স্পেস এক্স। আর ২০৩৪ এ নাসা নভোচারী পাঠাবে লাল্গ্রহটিতে । মঙ্গলে যাত্রা হতে যাচ্ছে এ শতাব্দীতে মানব জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন। নিশ্চয়ই এ অভিযান প্রভাব ফেলবে বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি এবং মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির উপর।

নবায়নযোগ্য শক্তি

২০৩০ সালের মধ্যে সকল পেট্রোল ও ডিজেল চালিত গাড়ি নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে ৫টি দেশ। এই ৫টি দেশের মধ্যে প্রতিবেশী ভারতও আছে। মূল উদ্দেশ্য বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং পরিবেশ দূষণ রোধ করা। আবার, এখনি আইসল্যান্ড ও নরওয়ে তাদের সব শক্তির উৎপাদনে ব্যবহার করছে নবায়নযোগ্য উৎস।আর ,পুরো বিশ্বব্যাপী বাড়ছে সৌরশক্তির ব্যবহার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্মাণ করা হচ্ছে সোলার-ফার্ম। এমনকি তেল নির্ভর সৌদি আরব ২০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সোলার-ফার্ম নির্মাণে।

এ দশকে ব্যাটারি নির্মাণে এবং ব্যাটারিগুলোর কর্মক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। এই উন্নতিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন “ব্যাটারি বিপ্লব ”। ব্যাটারির উপর সৌরশক্তির ব্যবহার যেহেতু অনেকাংশে নির্ভরশীল, তাই ব্যাটারির উন্নতির কারণে কোম্পানিগুলো নতুন ধরণের পণ্য তৈরী করতে আগ্রহী হচ্ছে। একই সাথে বাড়ছে বায়ু শক্তিচালিত উইন্ড-মিলের ব্যবহার এবং গবেষণা।

তবে শক্তি উৎপাদনে এ শতাব্দীতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রযুক্তি। বর্তমানে সকল; পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদিত হয়। কিন্তু ফিউশন প্রক্রিয়া ফিশন থেকে বহুগুনে কার্যকর এবং নিরাপদ। এই প্রযুক্তিটি সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারলে ভবিষ্যতে পৃথিবীর শক্তি-সঙ্কট সমাধানে এক ধাপ এগিয়ে যাবে মানবজাতি।

জিন প্রকৌশল প্রযুক্তি

কোনো জীবের জিনে কাঙ্খিত পরিবর্তন নিয়ে আসা যায়, জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে। ১৯৭২ সাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে ,জীন প্রকৌশল। বর্তমানে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে চিকিৎসা ,শিল্প ,কৃষি ও গবেষণা ক্ষেত্রে।

সম্প্রতি জিন প্রকৌশলীরা আবিষ্কার করেছেন এক নতুন প্রযুক্তি। নাম দেয়া হয়েছে CRISPR। এর ফলে পূর্বের তুলনায় এখন অনেক কার্যকর ভাবে জীবের ডিএনএ-তে পরিবর্তন আনতে পারবেন বিজ্ঞানীরা। আর ভবিষ্যতে জীন প্রকৌশলের ব্যবহার আরো বাড়বে। বর্তমান বিশ্বে এরই মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে জীন প্রকৌশল প্রযুক্তি।জিএমও এর ব্যবহার, ক্লোনিং থেকে শুরু করে মানুষের ক্ষেত্রে জিনের পরিবর্তন ইত্যাদি নীতিগত বিষয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো দ্বিধাবিভক্ত।

বন্যা ও খরা প্রতিরোধী নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভিদ তৈরি থেকে নতুন ওষুধ ,কৃত্রিম হরমোন তৈরিতে বর্তমানে ব্যবহার করা হচ্ছে এ প্রযুক্তি। ভারতীয় উপমহাদেশে এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে তৈরী করা হয়েছে ‘গোল্ডেন রাইস’। ভিটামিন এ সমৃদ্ধ এ ফসল অন্ধত্ব থেকে বাঁচিয়েছে অসংখ্য মানুষকে। আগামী দিনে মানুষের বংশগত রোগ নির্মূলে সক্ষম এ প্রযুক্তি। আবার মানুষ যখন পৃথিবীর বাইরে কলোনি স্থাপন করবে, এটা নিশ্চিত যে মানুষ নিজের জিনে নিজেরাই পরিবর্তন আনবে বেঁচে থাকার তাগিদে। কিন্তু প্রযুক্তিটির অসাবধান ব্যবহার তৈরী করতে পারে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু ,যা মানুষের অস্তিত্বতে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

প্রয়াত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মতে -“ জিন প্রকৌশল একটি ছোট পরীক্ষাগারে করা সম্ভব। বিশ্বের প্রতিটি পরীক্ষাগার নিয়ন্ত্রণ বা পর্যবেক্ষণে রাখা সম্ভব নয়, তাই দুর্ঘটনাবশত বা পরিকল্পিত ভাবে এমন ভাইরাস তৈরী হওয়া সম্ভব যা আমাদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিবে। ” আবার, হকিং এটাও বিশ্বাস করতেন যে,জিন প্রকৌশল প্রযুক্তির ব্যবহার দীর্ঘ মহাকাশ যাত্রাকে মানুষের জন্য সহনীয় করে তুলবে।

ভবিষ্যতের ভিত গড়ে দিবে আরো অনেক প্রযুক্তি। তবে এই চারটি প্রযুক্তির সুচিন্তিত ও মানবিক ব্যবহার ছাড়া মানুষের নিরাপদ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ কল্পনাতীত ।

লেখাঃ হাসিব মাহমুদ, যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগ, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

 73 total views,  1 views today

Share your vote!


Related Posts

To Buy Prohori

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

© 2024